কৌশিক সরকার : নোদাখালি প্রকল্প থেকে পানীয় জল সরবরাহের জন্য লস্করপুরে ভূগর্ভস্থ জলাধার তৈরি করেছিল বাম পৌরবোর্ডই। কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছিলো ওভারহেড রিজার্ভারও। জল সরবরাহ সবে চালুও করেছিল বাম পৌরবোর্ড। জলের জন্য চার্জ ছিল মাসে ২০ টাকা। গরিবদের থেকে অবশ্য তা নেওয়ার কথা ছিল না। এখন রাজপুর-সোনারপুর পৌরবোর্ড পরিচালনা করছেন বিরোধীরা। না, বিরোধীদের পরিচালিত বর্তমান পৌরবোর্ড জলের জন্য চার্জ নিচ্ছে না। নেবে কীভাবে! নোদাখালি প্রকল্পের জলই তো এই পৌরবোর্ড সরবরাহ করছে না। তৈরির পরেও এখন খাঁ খাঁ করছে ‘আন্ডার গ্রাউন্ড এবং ওভারহেড রিজার্ভার। পরিস্রুত পানীয় জল দোরগোড়ায় এসে থমকে গেছে পৌরবাসীর। ‘পরিবর্তন’ দেখছে সোনারপুর।
ভোটে জিতেও তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠী সংঘর্ষে কয়েক মাস চেয়ারম্যানসহ কাউন্সিল নির্বাচন করা যায়নি রাজপুর-সোনারপুরে। অবশেষে যেদিন তা ঘোষণা করা হলো, সেদিন এক রক্তারক্তি কাণ্ড। সবই দেখেছে সোনারপুর। ২০০৮-এর মে মাসেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা পরিষদে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস। আর, লোকসভা নির্বাচনের ঠিক পরেই ২০০৯ সালের জুন মাসে রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভাতেও ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। গত দু’বছরে জেলা পরিষদের কাজের নিরিখে নামতে নামতে রাজ্যের ১৯টি জেলার মধ্যে ১৮ নম্বর জেলায় পৌঁছেছে দক্ষিণ ২৪ পরগণা। আর, রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভার মতো যেখানে যেখানে তারা ক্ষমতায় এসেছে, সেখানেই মানুষ দেখছেন ‘পরিবর্তন’ এর মানে।
ডিলিমিটেশনের পরে সোনারপুর (উত্তর) নামে যে কেন্দ্রটি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে পড়ছে রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভার ১৭টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে ৬টি ওয়ার্ডে জিতেছিল বামফ্রন্ট। আর, পড়ছে পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা, খেয়াদহ ১ এবং ২, কামরাবাদ এবং বনহুগলী ১ এবং ২। এর মধ্যে তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতেছিল বামপন্থীরা। লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই সোনারপুর (উত্তর) বিধানসভা কেন্দ্রে বিরোধীদের তুলনায় বামফ্রন্ট পিছিয়ে প্রায় ১০ হাজার ভোটে। তবে ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে সোনারপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বামফ্রন্ট প্রার্থী শ্যামল নস্কর জিতেছিলেন প্রায় সাড়ে আট হাজার ভোটে।
গতবারে সোনারপুরের বিধায়ক, শ্যামল নস্কর এবারও বামফ্রন্ট মনোনীত সি পি আই (এম) প্রার্থী। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রাক্তন নেতা এবং রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভার প্রাক্তন পৌর পরিষদ সদস্য তিনি। অন্যদিকে, এই কেন্দ্রে বিরোধীদের প্রার্থী তৃণমূল কংগ্রেসের ফিরদৌসি বেগম। বর্তমান পৌরবোর্ডের ভাইস চেয়ারপার্সন। কিন্তু এক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের বিরোধের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলের ঘরের কোন্দল, পৌরবোর্ড গঠন নিয়ে যা তুঙ্গে উঠেছিল। আর ফিরদৌসি বেগম প্রার্থী হওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে গড়িয়া এবং নরেন্দ্রপুরের তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ও কর্মীদের মধ্যে। অবশ্য এলাকায় মানুষ ফিরদৌসিকে যতটা চেনেন তার থেকে বেশি পরিচিতি তার স্বামী নজরুলের, এলাকায় যাঁর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে মানুষের।
পরিবর্তনের নমুনা দেখে ফেলেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। দেখেছে, সোনারপুরও। দেখেছে, এখনই বিধায়ককে বেধড়ক পিটিয়েছে তৃণমূলীরা। দেখেছে, ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে নয়ছয়, যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন খোদ তৃণমূলের সাংসদ কবীর সুমন। খুড়িগাছি এলাকায় জোর করে টিপসই দিইয়ে নিয়ে প্রতিবন্ধী ভাতা, বার্ধক্যভাতা নিজেরাই তুলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। গঙ্গাজোয়ারার দিকে কয়েকটি গ্রামে সন্ত্রাস, ভয়-ভীতি, হুমকিও দিচ্ছে তৃণমূলীরা।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে খানিকটা পিছিয়ে শুরু করলেও, এই কেন্দ্রে জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী বামফ্রন্ট প্রার্থী শ্যামল নস্কর। তিনি বললেন, বাড়ি বাড়ি প্রচারে যে সাড়া পাচ্ছি, তা নির্ভেজাল। যে মানুষ সরে গিয়েছিলেন, তাঁদের কাছেও পৌঁছাচ্ছি। ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। বলছেন, অভিমানের কথাও। কিন্তু, নিজেদের অভিজ্ঞতাতেই এবার আর নিছক ‘পরিবর্তন’-এর জন্য পরিবর্তন চাইছেন না তাঁদের অনেকেই। আতঙ্কে আছেন, এলাকার ছোটো ছোটো ব্যবসায়ীরাও।
রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং সি পি আই (এম) নেতা কমল গাঙ্গুলি জানালেন, পৌরসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের ফলের প্রেক্ষিতে সাংগঠনিক যে দুর্বলতাগুলি ছিল, তা এখন অনেকটাই কাটানো হয়েছে। নিবিড় প্রচারের মাধ্যমেই মানুষের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে।
কামরাবাদের প্রকাশ মণ্ডল বা নির্মল মণ্ডলরা তাই এখন ব্যস্ত বাড়ি বাড়ি প্রচারের কাজে। কামালগাজির কাছে ইস্টার্ন বাইপাসের কাছে পেপসি কারখানায় কর্মরত যুবক থেকে তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছোটো ছোটো দোকানদার রিকশা চালকরা কিন্তু দেখছেন অন্য এক পরিবর্তনও,যে পরিবর্তনে গড়িয়া থেকে কামালগাজি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলো ইস্টার্ন বাইপাস। এখন তা সম্প্রসারিত হচ্ছে বারুইপুরের পদ্মপুকুর পর্যন্ত। সোনারপুরে গড়ে উঠছে একটি হার্ডওয়্যার ও ইলেকট্রনিক্স পার্ক। সেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করবেন অন্তত এগারো হাজার মানুষ। স্বভাবতই এই উদ্যোগগুলির ফলে যেমন এলাকাগুলির পরিষেবা,পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে, তেমনই বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ, যাকে ঘিরে আগ্রহ রয়েছে যুবক-যুবতীদের মধ্যে। আর, এসবই হয়েছে যাঁদের হাত ধরে, তাঁদের বিরুদ্ধেই আজ বিরোধীরা তুলছেন স্থবিরতার অভিযোগ। আর, যে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তাঁরা, তার নমুনা এখন বেশ মালুম হচ্ছে সোনারপুরের।
No comments:
Post a Comment